,

পাঠ আনন্দ ও পাঠকের অবিনির্মাণ

অলাত এহ্‌সান: ‘পাঠ আনন্দ’র একটি মৃত্যু বোধহয় সেদিনই ঘটেছে, যখন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সনদকে কর্মক্ষেত্রে ‘প্রধানতম’ যোগ্যতা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আর পরীক্ষার নাম্বার উন্নতি করতে গিয়ে সিলেবাস নির্ভরতা আমাদের পাঠের এলাকা সীমিত থেকে সংকীর্ণ করে তুলেছে। আজকের দিনে প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের পাঠবিমুখতা দেখে একথা অন্তত বলা যায়। অবশ্য শিক্ষা সনদের প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতির ভেতর দিয়ে স্বাক্ষরতা অর্জন এখন  গুরুত্বপূর্ণ একটি আবশ্যিক ও সার্বজনীন ধারা হিসেবে আর্বিভূত হয়েছে। তারপরও আজকের দুনিয়ার শতকোটি শিক্ষার্থীদের কাছে সংশয়হীনভাবে জিজ্ঞাসা করা যায় না—তোমার কাছে পাঠ আনন্দটা কেমন?
মধ্যবিত্তের পাঠ আনন্দ মারা গেছে আরো এক দূর্দৈবে। তারা সব সময়ই নিজেকে বঞ্চিত মনে করেন। এই বঞ্চনার প্রতিশোধ গ্রহণের একটি হাতিয়ার শিক্ষা অর্জন। তারা মনে করেন, পৃথিবী তাদের যা বঞ্চিত করেছে শিক্ষা গ্রহণের মধ্যদিয়ে তা অর্জন করা সম্ভব। ফলে নাক-মুখ, দম খিঁচিয়ে বিদ্যা অর্জন করতে গিয়ে অনেক আগেই পাঠ আনন্দ থেকে তারা নিজেদের সরিয়ে ফেলেন। এতে পুনঃ পুনঃ ডিগ্রি অর্জনের চূড়ান্তসীমা বেড়েছে মাত্র। মানে ম্যাট্রিকুলেশনের (বর্তমানে এসএসসি) সীমা থেকে উঠেছে ইন্টারমিডিয়েটে (বর্তমানে এইচএসসি), ইন্টারমিডিয়েট উঠেছে গ্রাজুয়েশনে আর গ্রাজুয়েশন উঠেছে মাস্টার্সে। হালে মাস্টার্সের সীমা ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জনে গিয়ে ঠেকেছে। কিন্তু পাঠ আনন্দ ধরা দেয়নি।
বিজ্ঞপ্তির শর্ত পূরণের জন্য অর্জিত সার্টিফিকেট আর চূড়ান্ত নিয়োগে মামা-খালুর তদ্বিরের ফলে চাকরি নিশ্চিত হওয়ার দ্বৈতরথের চাকায় বিদ্যার পার্শ্বজ্ঞানটাও পিস্ট হয়েছে। ফলে শিক্ষা অর্জন আরো নিকষ, বিরস হয়ে পড়েছে। এখন তা ঘানি টানার মতোই করুণ একটা কিছু! অথচ শিক্ষিতদের দার্শনিক ও সমাজ হিতৈষি ভাবার একটা প্রচলন এ দেশে ছিল; এখনো যে নেই তা নয়।
একবার গবেষক বিনায়ক সেন বলেছিলেন: ‘জিনস্, টয়লেট টিস্যু ব্যবহার করলেই শুধু প্রকৃত মধ্যবিত্ত হওয়া যায় না। জ্ঞানের বিকাশও থাকতে হবে সেই সমাজে।’ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ আরো ভালো বলেছিলেন: ‘ইউরোপে রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে যে মধ্যবিত্ত, সেই মধ্যবিত্ত এ দেশে হয়নি। এ দেশের মধ্যবিত্ত ৮০ হাজার টাকা দিয়ে আইফোন কেনে, কিন্তু বই কেনে না।’ প্রতিবছর ক্লাস পেরুনোর পর পাঠ্যপুস্তক ও কাগজের ওজন বাড়ানো গাইডগুলো কেজি দরে বিক্রি করে দেয়ার পর তাদের ঘরে আর কোনো বই থাকে না; মানে যাদের বলা হয় ‘বাইরের বই’। সুতরাং এই মধ্যবিত্তের উত্তর প্রজন্মের হাতে এমন কোনো কাঠি (বই) নেই যা নিয়ে জ্ঞানের ‘রিলে রান’ (জ্ঞানার্জন) শুরু করতে পারে। বিদ্যার্জনও যে ফসলী জ্ঞানের মতো বংশ পরাম্পরায় এগিয়ে যায়, তা আমরা লক্ষ্য করি না।
ইতালিয় তাত্ত্বিক, দার্শনিক ও ঔপন্যাসিক উম্বার্তো একো জ্ঞানের উৎস হিসেবে পেয়েছিলেন বাড়ির আন্ডার গ্রাউন্ডে প্রপিতার রেখে যাওয়া শত শত বই। অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য প্রপিতা বাড়িতে বই বাঁধাইয়ের কাজ করতেন। তার কাছে বাঁধাই করতে দেয়া বইয়ের অনেক মালিক তা গ্রহণ না করলে এবং তার মৃত্যুর পর কেউ নিতে না এলে বইগুলো আন্ডার গ্রাউন্ডে পড়ে ছিল। এই বইয়ের পাঠ আনন্দই যে তাকে দার্শনিক-তাত্ত্বিক করে তুলেছে একথা তিনি অনেকবার স্বীকার করেছেন। এ প্রসঙ্গ আরেকটু এগিয়ে নেয়ার আগে এই লেখকের চিন্তায় ‘পাঠ আনন্দ’ কী তা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। নয়তো ভুল বোঝার অবকাশ থেকে যায়।
লেখার শিরোনামে উল্লেখ আছে ‘পাঠ আনন্দ’। লক্ষ্য করুন ‘আনন্দ পাঠ’ নয় কিন্তু। মানে ‘আনন্দ পাঠ’ আদৌ এই লেখকের কাছে ‘পাঠ আনন্দ’ বোঝায় না। ‘আনন্দ পাঠ’ হচ্ছে কিছু পাঠ করতে যে আনন্দ; মানে সহজবোধ্য, ভাষার সরলতায় পড়তে আরাম লাগে, মনের কোথাও খটকা লাগে না, কোথাও আঁচড় লাগে না ইত্যাদি। অনেক সময় তাকে ঘুম পাড়ানিয়া গানের সঙ্গেও তুলনা করা যায়। কিন্তু ‘পাঠ আনন্দ’ হচ্ছে পাঠ উদ্ধার করা, পাঠের পর উদ্ধার করা জ্ঞান, যা আনন্দ পাঠ না হলেও অর্জন করতে হয়।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই, সৃষ্টির পর প্রাকৃতিক ও বন্য দুনিয়া থেকে বর্তমান অবস্থায় আসতে অনেক চড়াই-উৎড়াই পাড় করেছে সমাজে। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে অজস্র জ্ঞান ও সংস্কার। এসবের উদ্দেশ্যও নিরপেক্ষ নয়। অনেক সময় তা হীন উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই তৈরি হয়েছে। তারপরও এসব ধরে রাখার প্রবণতা মধ্যবিত্তের ভেতর প্রবল। কিন্তু জ্ঞান সব সময়ই পরিবর্তনশীল, সব সময়ই নিজেকে সমসাময়িক করে রাখে, সীমার সম্প্রসারণ ঘটাতে চায়। এটাই হচ্ছে জ্ঞানে বৈজ্ঞানিকতা। এজন্য তাকে সব সময় ভাঙা আর পুনঃনির্মাণের ভেতর দিয়ে যেতে হয়।
‘পাঠ আনন্দ’ হচ্ছে তাই, যা এই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়। পুরনো উদ্দেশ্য ও সংস্কার সরিয়ে নতুন নির্মাণ তরান্বিত করে। লেখা ভেঙে তার অর্থ পুনঃনির্মাণের কাজ করা, যাকে তত্ত্বীয়ভাবে বলা হচ্ছে ‘ডিকনোস্ট্রাকশন’। এখানে ব্যাখ্যা খানিকটা সরল হলেও, পাঠের এই পদ্ধতির তত্ত্বায়ন করেছেন ফরাসি দার্শনিক জাঁক দেরিদা। যদি আমরা জ্ঞানে এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ব্যবহার আর সংস্কার (কুসংস্কারও) স্বীকার করে নেই, তাহলে ‘পাঠ আনন্দ’র কাজ বহিঃপ্রকাশ হবে পাঠকের বা মধ্যবিত্তের সংরক্ষণবাদিতাকে ভেঙে দেয়া। ‘ডিকনোস্ট্রাকশ’-এর বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘বিনির্মাণ’ প্রচলিত, কিন্তু প্রাবন্ধিক অমল বন্দ্যোপাধ্যায় ‘উত্তর আধুনিকতা ও কয়েকজন ফরাসি ভাবুক’ গ্রন্থে দেরিদা বিশেষজ্ঞ গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের দোহাই দিয়ে আমাদের জানাচ্ছেন, এর কাছাকাছি বাংলা হতে পারে ‘অবিনির্মাণ’। পাঠ অভিজ্ঞতায় ‘আনন্দ পাঠ’ থাকলেও, যা পাঠককে ভেঙেচুড়ে ‘অবিনির্মাণ’ করেছে তাকেই এখানে ‘পাঠ আনন্দ’ বলা হচ্ছে।
প্রমথ চৌধুরী যেমন বলেছিলেন: ‘স্বশিক্ষিত লোক মাত্রই সুশিক্ষিত।’ এক্ষেত্রে বলা যায়, পাঠ আনন্দের মধ্য দিয়েই অর্জিত হয় সৃজনশীল জ্ঞান। এবার সৃজনশীলতাহীন জ্ঞানকে আমরা প্রকৃত জ্ঞান বলবো কি না, সে আরেক প্রশ্ন।
শৈশবে কলেজ পড়ুয়া মেজো ভাইয়ের টেবিলে নিউজপ্রিন্ট কাগজে ছাপা ঢাউস এ্যাডভান্স একাউন্টিংয় বইয়ের ফাঁকে একদিন আবিষ্কার করেছিলাম একটু ছোট আকারের বই—মনীষীদের জীবনকথা। শাহনাজ ফেরদৌসের লেখা। শিশুদের উপযোগী। সেখানে তিনজন সাহিত্যিক ও পাঁচজন বিজ্ঞানীর জীবনী ছিল। তাদের এক-একটা জীবন শিশু মনের স্বস্তি ভেঙেচুড়ে দিয়েছিল। বিশেষ করে বইয়ে বিজ্ঞানীদের শিশুবেলার নানা কাণ্ড—টমাস আলভা এডিসন মুরগির ডিমে নিজে তা দিয়ে বাচ্চা ফুটানোর চেষ্টা করেছিলেন। বইটা চুপচাপ ও তুমুল শাসনে থাকা জীবনের ভেতরে নানা কৌতূহলের অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল। এমন অভিজ্ঞতা অনেকেরই হয়েছে। নিজের কৌতূহল নির্বাপনের কাজে আত্মসম্মান খোয়া যায় না। কারণ তখন পর্যন্ত মক্তবে শোনা ধর্মীয় মহাপুরুষের জীবন শ্রুতি নির্ভর ও কল্পনায় স্পর্শনীয় বলে মনে হয়। তারা ‘সুবোধ জীবনের’ কোনো আঁশ খসায় না, যতটা খসাতে পারে ওই এক চিলতে বই।
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো আনন্দ পাঠ তৈরির আগেই উপদেশে ভরিয়ে তুলতে চায়। ফলে পাঠ আনন্দও মাঠে মারা যায়। স্কুলপাঠ্য বইয়ের ‘ভাল কাজ’ গল্পটা বাড়ির বড়দের শাসন আর উপদেশের আদলে মোড়া। কিন্তু অপাঠ্য বইয়ে জসীমউদ্‌দীনের ‘বোকা বুড়ির গল্প’ অনেক বেশি শিক্ষণীয়। সরাসরি কোনো উপদেশ না দিয়ে গল্পের ছলেই বুঝিয়েছেন হঠাৎ করে কেউ বিপুল সম্পদের মালিক হলে তাকে সমাজ প্রশ্ন করবেই। আর দরিদ্রকে সম্পদ রক্ষায় কৌশলী হতে হয়। গল্পের এই চর্চাই বোধ করি সৃজনশীলতার উচ্চতর প্রকাশ।
স্কুলের সঙ্গে লাইব্রেরির দূরত্ব অনেক। ফলে শৈশবে ঠাকুরমার ঝুলি বা ভৌতিকগল্প পড়ার আনন্দটুকুও ঠিক ধারা পেয়ে ওঠে না। ফলে পাঠ্য বইয়ের বাইরে বই পড়ার বিস্তার ঘটে না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যে সমৃদ্ধ একটা লাইব্রেরি থাকতে পারে, সেটা বুঝতে হয় কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে। বিজ্ঞানের বইগুলো যেমন ধর্ম ও সংস্কার নির্ভর বিশ্বাসগুলো একে একে খুলে ফেলে।
কলেজের লাইব্রেরিতে মাহমুদুল হকের ‘নিরাপদ তন্দ্রা’ উপন্যাসের কয়েক পাতা পড়ার পর মুগ্ধ হয়েছিলাম। বইয়ের ভাষা ও বুনন পাঠককে এভাবে বিভোর করতে পারে সেবারই প্রথম অনুভব করেছিলাম। লেখকের আরো অন্যান্য বই এভাবে বিমোহিত করে না। তার ‘জীবন আমার বোন’ বা ‘কালো বরফ’র সুখ্যাতি দেখা যায়। কিন্তু তা সাহিত্যের ঘুরপাক খাওয়া সেই প্রজেক্ট রাইটিং, দায় শোধ করা, বরং ‘নিরাপদ তন্দ্রা’ই নিজের সাহিত্যকর্ম। দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি নিয়ে হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের সাহিত্য আমাদের উন্মোচন করেছে জনপ্রিয় ইতিহাসের চাপাপড়া গণইতিহাসের ইতিবৃত্ত। আমাদের দাঁড় করিয়ে দিয়েছে অসহনীয় অস্তিত্বের সামনে। শহীদুল জহির আবিষ্কার হন সেই পথেই।
এই লেখকের গল্পের ভাষার তারিফ সবখানে। তার গল্পে প্রসঙ্গ ও ঘটনার পুনরাবৃত্তির প্রসঙ্গ সমালোচকরা প্রায় এড়িয়েই যান। অথচ তার সাহিত্য আমাদের মনে করিয়ে দেয় ইতিহাস নিয়ে সেই বিখ্যাত তর্ক—ইতিহাস সরল রৈখিক না বৃত্তাকারে চলমান? ইউরোপে অধিকাংশ দার্শনিক ও ইতিহাস তাত্ত্বিকদের কাছে ইতিহাস ঋজু (সরল), কিন্তু উত্তর-আধুনিক দার্শনিকরা প্রমাণ করছেন ইতিহাস বৃত্তাকার। ফরাসি দার্শনিক জাঁ বোদ্রীয়ার বরং এই দুটো সমন্বয় করেছেন। তারা কাছে অজস্র বৃত্ত আবর্তিত হয়ে একটা রেখার তৈরি হয়েছে।
কলেজের লাইব্রেরিতেই একদিন আবিষ্কার করেছিলাম আর্নেস্ট হেমিংওয়ের ‘দি ওল্ড ম্যান এন্ড দ্য সি’; নিঃসঙ্গতার ভেতরও কী লড়াকু জীবন! অথচ আমাদের কাছে মনে হয়, নিঃসঙ্গ হলে বুঝি মরেই যাবো। সবচেয়ে বিহ্বল করেছিল আলবেয়ার কাম্যুর ‘দি আউটসাইডার’। জগতের সব কিছু বুঝে তাকে উপেক্ষা করেও এমন দম নিয়ে জীবন যাপন করা যায়! জীবনের একটা সমৃদ্ধিবোধ এনে দেয়ে এই বই। এটা তার অস্তিত্ববাদ দর্শনের সবচেয়ে বড় ব্যবহার। রাজনৈতিক দর্শনের সূত্রে ম্যাক্সিম গোর্কির সন্ধান উন্মোচন করে গোটা সোভিয়েত সাহিত্যের জগৎ। সেখানে অনেক লেখকের মধ্যে বিশেষ করে ফিউদর দস্তয়েভস্তি, লিও তলস্তয় সারাজীবনের সমৃদ্ধ পাঠ বলা যায়। তলস্তয় নিয়ে পড়তে গিয়ে খোঁজ মেলে মিলান কুন্দেরার। তিনি দেখিয়ে ছিলেন তলস্তয় ও ফ্রানৎস কাফকার সাহিত্যের বৈপরিত্য। তলস্তয়ের চরিত্ররা অপরাধ বোধে ভুগছে, খুঁজে নিচ্ছে শাস্তি; অপর দিকে কাফকার চরিত্রের জন্য আগে থেকেই নির্ধারিত হয়েছে শাস্তি, তারা খুঁজে খুঁজে অপরাধ বের করছে।
কাফকা প্রভাবিত লেখক তালিকাও দীর্ঘ, যা আমার ভেতর আরো এক জগৎ উন্মোচন করেছে। এর মধ্যে হোর্হে লুই বোর্হেসের কথা ঊর্ধ্বে। পাণ্ডিত্বকে গল্পে ব্যবহার আর কোনো লেখকই এতটা দক্ষতায় প্রকাশ করেন নি। অনেকে মনে করেন, বিশ্বগল্প কাফকা দ্বারা দু’ভাবে বিভক্ত—কাফকা পূর্ব ও কাফকা পরবর্তী সাহিত্য। একথা স্বীকার করে নিয়েও বলতে হবে, কাফকা পরবর্তী বিশ্বসাহিত্য বোর্হেস দু’ভাবে বিভক্ত করেছেন। এখন সে কথা মনে রেখে সাহিত্য করলে কালের ধুলায় হারিয়ে যাবে না।
মানুষ তার নিজের বিশ্বাসের স্বস্তি নিয়ে থাকতে চায়। ফলে সমাজে বেড়ে উঠতে উঠতে যে ধারণা-সংস্কার পায়, তাকেই ধরে রাখতে চায়। জ্ঞানের পথে হেঁটে নিজেকে উন্মুক্ত প্রান্তরে আবিষ্কার করতে চায় না। তাই নিজের অবস্থান ও বিশ্বাসকে অটুট ও সংরক্ষণ করতে চায়। এই সংরক্ষণবাদী মানসিকতায় মধ্যবিত্ত এগিয়ে। যদিও সংরক্ষণবাদীতা ক্ষমতার সঙ্গেও যুক্ত।
স্বাধীনতা পূর্ব সময় থেকে এই দেশে সোভিয়েত সাহিত্যের সম্ভার উন্মুক্ত হয়েছিল। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মার্কিন প্রপাগণ্ডা নির্ভর সাহিত্য চর্চাও কম হয়নি। স্বাধীনতার পর উন্মোচন হয়েছে সাহিত্য পাঠের নতুন এলাকা লাতিন আমেরিকা। সেই সঙ্গে আফ্রিকান সাহিত্যের একটা স্রোত বয়ে গেছে। ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকান সাহিত্যও সরগরম ছিল সব সময়। তখন উর্দু সাহিত্যেরও বিশ্ব জাগরণ দেখা গেছে। কিন্তু আজকের দিনে কোনো মহাদেশ বা সময় নয়, কোনো কোনো দেশ এককভাবেই বিশ্ব সাহিত্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে, সেই দিকে নজর দেয়া দরকার। যেমন জাপান। বিশ্ব সাহিত্যে দেশটি উপত্যকার মতো দাঁড়িয়ে আছে। ইতিহাস বিশ্লেষণের ‘বংশানুচরিত তত্ত্ব’ ব্যবহার করে পেছনের দিকে দেখলে হারুকি মুরাকামির আগে কাওয়াবাতা ইয়াসুনারি, ইউকিউ মিশিমা, আকুতোগাওয়া রিউনুসুকে, ওয়ে কেনজাবুরর ইত্যাদির নাম পাওয়া যায়। ওয়ে কেনজাবুরর ‘শিকার’ গল্পে গাঢ় ভাষা এবং কাওয়াবাতার গল্পে নতুন জগতের সন্ধান পাওয়া যায়।
কোনো কোনো সাহিত্যিক নিজেই একটা সাম্রাজ্য। সরাসারি সাহিত্যের বিষয় না হলেও, সাহিত্যে সর্বাপেক্ষা প্রভাব বিস্তারকারী সিগমুন্ড ফ্রয়েড ও কার্ল মার্ক্সকে এই বিবেচনায় আনা যায়। আর সাহিত্যের দিক দিয়ে হালে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস অন্যতম। তুরস্কের ওরহান পামুকও তাই। হোসে সারামাগোর ‘দ্য ব্লাইন্ডনেস’ পড়ার পর প্রায় চমকে উঠতে হয়, এভাবে মগজ খামচে ধরে একটা গল্প বলা যায়! পড়তে পড়তে অনেক পাঠকেরই মনে হয়—উপন্যাসের চরিত্রের মতো আমিও বুঝি শ্বেত অন্ধত্বে আক্রান্ত হয়েছি। শ্বেত শুভ্রতা এখানে ‘সাদাই মানে ভাল, সাদা মানেই আলো; কালো মানে খারাপ, খারাপ মানেই অন্ধকার’ ধারণার ঔপনিবেশকতাকে সমালোচনার মধ্যে আনে। তিনি দেখান, গোটা সমাজ কীভাবে অন্ধ হয়ে যেতে পারে লোভ ও ক্ষমতার মোহে। যদিও এই অন্ধত্বের উৎস সম্পর্কে তাদের সচেতনতা নেই, কেবল মুক্তির হাঁসফাঁস ছাড়া।
তাবৎ দুনিয়ায় ধর্মগ্রন্থগুলোর একপ্রকার মুক্তি ঘটেছে সাহিত্য হিসেবে গ্রহণ করায়। আধুনিক সাহিত্যের অনেক ধারণার চেয়েও এগিয়ে এর ফ্যান্টাসি। যদিও আরজ আলী মাতুব্বরের পাঠ উদ্ধারের চেয়ে তা আলাদা। জোসেফ ক্যাম্পবেল ‘পাওয়ার অফ মিথ’ ও ক্লদ লেভি ত্রস ‘স্টাকচারাল মিথোলজি’ দিয়ে মিথকে আধুনিক মানুষের প্রজ্ঞার অনেক কাছে এনেছেন।
নতুন নতুন বইয়ের আবিষ্কারও পাঠ আনন্দের অংশ। এর কোনো সীমা নেই। বিশেষ করে যারা কোনো ‘অভিভাবক’ ছাড়া অনেক ফালতু-মামুলি বই পড়ে ভালো বই, নতুন চিন্তায় আলোড়িত হওয়ার মতো বই চিনতে শেখেন, তাদের কাছে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। তাই লেখা মুড়িয়ে আনার জন্য সদ্য পড়া বইয়ের কথা বলতে হয়। গত বছর আগোরে-বাগোরে কিছু পড়া হয়েছে। এর মধ্যে নৃ-তাত্ত্বিক গ্রন্থ লুইস হেনরি মর্গানের ‘এনসিয়েন্ট সোসাইটি’, দর্শন বিষয়ে অমল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘উত্তর-আধুনিক চিন্তা ও কয়েকজন ফরাসি ভাবুক’ এবং সাহিত্যে অমিতাভ ঘোষের উপন্যাস ‘ছায়া রেখা’ (শ্যাডো লাইনস-এর অনুবাদ) গুরুত্বপূর্ণ। নীলক্ষেতে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কেনা ‘ছায়া রেখা’র লেখক অমিতাভ ঘোষ সম্পর্কে কিছুই জানতাম না। বছরের গোড়ায় উপন্যাসটি পড়তে শুরু করে নতুন ভাষা আবিষ্কার করেছিলাম। লেখার প্রথম লাইন বা প্যারায় পাঠককে গেঁথে ফেলার পাশাপাশি ভাষাটা গুরুত্বপূর্ণ। এই উপন্যাসের ভাষা সম্পর্কে খুশবন্ত সিং বলেছিলেন, উপন্যাসের ভাষা কেমন হওয়া উচিত এবং কীভাবে লেখা উচিত তা এই বই থেকে নমুনা নেয়া যেতে পারে। মানুষের হাড় পরীক্ষা করলে যেমন অস্থি গঠনের সময় সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়, তেমনি একটি পারিবারিক ঘটনায়ও লুকিয়ে থাকে ইতিহাসের ঘাত, পরিক্রমার দলিল।
উত্তর-আধুনিক দার্শনিক মিশেল ফুকো বংশানুচরিত তত্ত্ব ব্যবহার করে দেখিয়েছিলেন ইতিহাসের ভেতর অনেক ফাঁক আছে। ঋজু ইতিহাস চর্চাকারীরা তা উপেক্ষা করে যান, যা তাদের ক্ষমতায় আরোহণের উত্তরাধিকার ও সুসংহত করার বৈধতা দেয়। কিন্তু ইতিহাসের ফাঁক জানা থাকলে তার সমালোচনা হাজির করা যায়। অমিতাভ ঘোষ তার উপন্যাসে ইতিহাসের একটা ফাঁক ধরিয়ে দিয়েছেন আমাদের। তিনি ইতিহাস লেখেন না, বরং মানুষের আপাত সংসারী-নিরীহ জীবনের ভেতরও যে ইতিহাস লুকিয়ে থাকে, উপরোন্তু এই সামাজিক মানুষ যে ইতিহাসজাত, তা ধরিয়ে দেন।
ফ্রয়েড সবচেয়ে বেশি বিব্রত করেছিলেন মধ্যবিত্তকে, তাদের অবচেতনে লুকিয়া থাকা লোলুপতা, বিরংসাকে সামনে এনে। মধ্যবিত্তরা তার অবচেতন ধারণা গ্রহণ করতে না পারলেও অস্বীকার করতে পারেন নি। ফ্রয়েডের অবচেতন তত্ত্ব দ্বারা আমাদের দেশের সব লেখকই কমবেশি অনুপ্রাণিত। অনেকে এটা ধ্রুব সত্য বলেও ধরে নিয়েছেন। কিন্তু এটা যে বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নীরিক্ষার ওপর প্রতিষ্ঠিত নয়, তা প্রায় ভুলেই গিয়েছেন। ফ্রয়েডের অবচেতন অধিবিদ্যা সমালোচনা করেছেন জাক দেরিদা, আর ফ্রয়েডকৃত ‘শ্রেবের-কেস’ পুনঃবিশ্লেষণ করে জাক লাকাঁ দেখিয়েছেন তার ভেতর লুকিয়ে ছিল ভুল সমীকরণ। ফ্রয়েডের দুর্গে সবচেয়ে বড় আঘাত হেনেছেন জিল দলয়জ। তিনি দেখালেন ফ্রয়েডের অবচেতন ধারণার ভেতর কেবল ভুল নয়, তিনি বরং খ্রিস্টিয় ‘পাপবাদ’ ধারণাকেই ফিরিয়ে এনেছেন। আঠারো শতকীয় খ্রিস্টিয় পাপ ধারণার অবর্তমানে ‘ইডিপাস-কমপ্লেক্স’ ধারণের মধ্যে দিয়ে আধুনিক মানুষের ওপর আরোপ করেছেন পাপের ভাড়। ফ্রয়েড উত্তর দার্শনিকদের ধারণাও টিক থাকবে এমন আশা করা যায় না, কিন্তু তাদের ব্যাখ্যা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
সব অবস্থায় মধ্যবিত্তের মানিয়ে নেয়ার ক্ষমতা তাকে বাঁচিয়ে রাখছে যুগের পর যুগ, তেমনি তাকে স্রেফ তেলাপোকায় পরিণত করে, যা সব অবস্থায় বেঁচে থাকার নিশ্চয়তায় শত শত বছর বংশ রক্ষা করলেও পতঙ্গে ঊর্ধ্বে উঠতে পারেনি। ‘তেলাপোকা একটা পাখি আর মধ্যবিত্তও একটা মানুষ’ কথাটা বোধ হয় সেখানে থেকেই এসেছে। মধ্যবিত্তের এই মানিয়ে নেয়া সম্পর্কে অমিতাভ ঘোষ এক প্রতিবেদনে লিখেছেন: ‘ইতিহাসেরই বিরুদ্ধে ঘোষণা করা এক যুদ্ধ…মধ্যবিত্তের ওপর পরিকল্পিত ও বিরামহীন ভাবে আক্রমণ নামিয়ে আনা…যদি সেই পরীক্ষা-নিরীক্ষা আদৌ কিছু প্রমাণ করে থাকে, তবে শেষ পর্যন্ত তা হল যে মধ্যবিত্তকে কখনও ধ্বংস করা যায় না, কিছুতেই ধ্বংস করা যায় না তার হার-না-মানা অসাধারণ প্রতিরোধকে, সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে জ্ঞান ও অভিব্যক্তির নিজস্ব ধরনকে টিকিয়ে রাখার ক্ষমতাকে।’
আমরা যে মধ্যবিত্তীয় মানসিকতাকে সব সময় সমালোচনার ফলার খোঁচায় নাচিয়ে রাখি, এই মধ্যবিত্ত থেকেই বিপ্লবী নেতৃত্ব আশা করে মহুর্মুহ ব্যাখ্যা দিয়ে যাচ্ছে বামপন্থী সংগঠনগুলো। এজন্য তাকে নিজের খোলস ভাঙতে হবে। পাঠ আনন্দের মধ্য দিয়েও তা ভাঙা যায়। পাঠ আনন্দ মানেই তো পাঠকের অবিনির্মাণ। অবিনির্মাণের বই নিয়ে প্রয়াত ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক হুমায়ূন আজাদের ‘বই’ ছড়া থেকে উদ্বৃত করা যায়: ‘…যে-বই জ্বালে ভিন্ন আলো/ তোমায় শেখায় বাসতে ভালো/ সে-বই তুমি পড়বে। …যে-বই তোমায় অন্ধ করে/ যে-বই তোমায় বন্দী করে/ সে-বই তুমি ছুঁবেই না।’ কী আশ্চর্য, এই কবিতাটা পাঠ্য বই থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তাহলে শিক্ষার্থীরা পাঠ আনন্দ শেখার উৎসাহ পাবে কোথা থেকে?

লেখক: গল্পকার, প্রাবন্ধিক 

এই বিভাগের আরও খবর